ডান্ডি অভিযান

  • ১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হিসাবে "পূর্ণ স্বরাজ" অর্জনের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস "পূর্ণ স্বরাজ" দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
  • সভাপতির ভাষণে জওহরলাল নেহেরু আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব দেন এবং আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব মহাত্মা গান্ধীর উপর অর্পণ করা হয়।
  • দেশের বৃহত্তর অংশের জনগণের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে গান্ধীজী জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য লবণের উপর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বসানো কর এবং দেশীয় পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদনের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে একটি অহিংস করপ্রদান-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেন।
  • লবণ আইন ভঙ্গের উদ্দেশ্যে গান্ধীজি তাঁর ৭৮ জন অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ গুজরাতের আমেদাবাদের সবরমতি আশ্রম থেকে ডান্ডি গ্রাম পর্যন্ত যে দীর্ঘ পদযাত্রা করেন, ইতিহাসে তা ডান্ডি অভিযান নামে পরিচিত ।
  • ২৪ দিনে ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার) পথ পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে ১৯৩০ সালের ৬ই এপ্রিল ভোর সাড়ে ৬টার সময় বিনা-করে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর সঙ্গে তাঁর লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন।
  • ১৯৩০ সালের ৪ মে মধ্যরাতে গান্ধিজী-কে অবৈধভাবে লবণ উৎপাদনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
  • ১৯২০-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পর লবণ সত্যাগ্রহই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠিত ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন।
  • সুভাষচন্দ্র এই লবণ আইন ভঙ্গ প্রসঙ্গে ' The Indian Struggle ' গ্রন্থে বলেছেন — আমার মতে এটা ছিল এক মহান আন্দোলনের মহান সূচনা ( ‘ In my view it was a great beginning of a great movement ’ ) ।

আইন অমান্য আন্দোলন

১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হিসাবে গৃহীত "পূর্ণ স্বরাজ" অর্জনের দাবিতে গান্ধিজির নেতৃত্বে ডান্ডি অভিযানের মধ্য দিয়ে লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়।

আন্দোলনের প্রসার :-

  • কলকাতার মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রকাশ্য জনসভায় নিষিদ্ধ গ্রন্থ পাঠ করে রাজদ্রোহ আইন ভঙ্গ করেন।
  • তামিলনাড়ুতে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এবং অন্ধ্র ও উড়িষ্যায় 'উৎকলমণি' গোপবন্ধু চৌধুরী-র নেতৃত্বে আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়।
  • মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে অরণ্য আইন ভঙ্গ করে ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন করা হয়।
  • গান্ধীজী ১৯৩০ সালের ১০ই এপ্রিল 'ইয়ং ইন্ডিয়া' পত্রিকা মারফৎ ভারতীয় নারীদের এই আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
  • পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুরু হয় চৌকিদার কর বন্ধ আন্দোলন।
  • ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে সূর্যসেন এর নেতৃত্বে বাংলার বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে।
  • উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে 'সীমান্ত গান্ধী' আব্দুল গফফর খান-এর নেতৃত্বে 'রেড শার্ট' বা 'লাল কোর্তা' দল দ্বারা আইন অমান্য আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারন করে।
  • গান্ধীজী সুরাট জেলার ধরসানায় সরকারী লবণ গোলা দখল করা স্থির ৫ই মে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ওয়ার্ধা জেলে আটক করা রাখা হয়।
  • এরপর এই কাজের দায়িত্ব নেন আব্বাস তায়েবজী। তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হলে ২১শে মে সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে প্রায় ২৫০০ সত্যাগ্রহী নিয়ে এই অভিজান চালনা করা হয়।
  • ১৯৩১ সালের ৫ই মার্চ স্বাক্ষরিত গান্ধী-আরউইন চুক্তির মাধ্যমে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত থাকলেও ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা ও ভারতে ফিরে ব্রিটিশ সরকারের সৈরতান্ত্রিক মনোভাব লক্ষ্য করে গান্ধিজি ১৯৩২ সালের ৩রা জানুয়ারি পুনরায় সত্যাগ্রহের ডাক দিলেন।
  • বিক্ষিপ্ত ভাবে ভারতের বিভিন্ন অংশের মুসলিমরা এই আন্দোলনে যোগদান করলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশ এই আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। কারন একদিকে যেমন মুসলিম নেতারা এই আন্দোলন বয়কট করে অন্যদিকে তেমনি সরকার সাম্প্রদায়িক দ্বন্ধে উৎসাহ দিয়েছিল।

আন্দোলন দমন :-

  • আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার নিষ্ঠুর দমন নীতি গ্রহণ করে।
  • সত্যাগ্রহীদের ওপর নির্বিচারে পুলিশের লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ, গ্রেফতার কোনো কিছুই বাদ যায় নি ।
  • ১৯৩০ সালের ১লা এপ্রিল পুনরায় 'বেঙ্গল ল' বিধিবদ্ধ করা হয়।
  • ১৯১০ সালের প্রেস অর্ডিন্যান্স পুনঃপ্রবর্তিত করে ১৩১টি সংবাদপত্রকে জরিমানা, ৬৭ট সংবাদপত্র ও ৫৫টি ছাপাখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
  • জাতীয় কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করা হয়।

আন্দোলন প্রত্যাহার :-

  • ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড 'সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা' () নীতি ঘোষণা করেন।
  • হিন্দু সম্প্রদায়কে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত হিন্দু - এই সম্প্রদায়ে ভাগ করার প্রতিবাদে ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে গান্ধীজি যারবেদা জেলে আমরণ অনশন করেন।
  • তাঁর অনশনে আইন অমান্য আন্দোলন চাপা পড়ে যায় এবং তাঁর জীবন রক্ষার প্রশ্নই বড় হয়ে উঠল।
  • তফসিলি নেতা ডঃ বি. আর. আম্বেদকার-এর সঙ্গে গান্ধিজির টানা ছয়দিন ধরে আলোচনা চলার পর ১৯৩২ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর পুনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গান্ধীজী ২৬শে সেপ্টেম্বর অনশন ভঙ্গ করেন এবং বিনাশর্তে মুক্তি পেলেন।
  • কারামুক্তির পর গান্ধীজী হরিজন আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং গণ-সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের ডাক দেন।
  • ১৯৩৩ সালের ১লা আগস্ট থেকে ১৯৩৪ সালের মার্চ এই ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ চালু থাকলেও ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে।
  • ১৯৩৪ সালের ৮ই মে কংগ্রেসের পাটনা অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়।

গুরুত্ব:-

  • আইন অমান্য আন্দোলন তার ঘোষিত লক্ষ্য 'স্বরাজ' অর্জনে ব্যর্থ হলেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল।
  • বিদেশী পণ্য বয়কট ও স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের ফলে ভারতের বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়।
  • জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।